বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর পর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তাই ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার সর্বত্র। এতে বাড়ছে ই-বর্জ্য। এতদিন ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে কোনো বিধি-বিধান ছিল না। ২০২১ সালে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ করে সরকার; কিন্তু দুই বছর পার হলেও সেই বিধিমালার বাস্তবায়ন নেই। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য। 

ই-বর্জ্য হচ্ছে—সব ধরনের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য বা অংশবিশেষ বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়েছে বা ভাঙা বর্জ্য, যা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ফেলে দেওয়া হয়।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও সরকার তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়ায় বাংলাদেশে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু ই-বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা কাঠামো নেই। মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা কম। সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ই-বর্জ্য যে যার মতো ব্যবস্থাপনা করছে। এসব কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য। 

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান যেমন—সীসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ব্রেইন, হার্ট ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইকো সিস্টেম নষ্ট করে। ই-পণ্য সামগ্রী ব্যবহারের ক্রম ঊর্ধ্বমুখিতায় ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ও ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ই-বর্জ্য একটি নতুন বিষয়। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরকার জোর দিচ্ছে। সব ক্ষেত্র কাভার করতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা থাকলেও ই-বর্জ্যরে জন্য আলাদা করে বিধিমালা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

পরিবেশ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ১৩ কোটির বেশি মোবাইলফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রায় ১০ লাখ ল্যান্ডফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মোবাইলফোন সেট আমদানি করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি তথা মোবাইল সেট, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে, একই সঙ্গে ই-বর্জ্যরে পরিমাণও বেড়েছে। 

দেশের একমাত্র ই-ওয়েস্ট কোম্পানি

সিটি করপোরেশনগুলো এখনো ই-বর্জ্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করার সক্ষমতাও নেই সিটি করপোরেশনগুলোর। দেশে একমাত্র আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেড ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে। 

আজিজু রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইদুর রহমান শাহীন বলেন, বিধিমালা বাস্তবায়ন করা হলে ই-বর্জ্যরে মাধ্যমে যে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে তা রোধ করা সম্ভব। 

তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের একটি ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছি। সার্কিটবোর্ডগুলো আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেই। নারায়ণগঞ্জ কারখানায়ও ই-বর্জ্যরে কিছু অংশের পুনঃচক্রায়ন আমরা করি।’

ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘আমরা সার্কিটবোর্ড পুনঃচক্রায়ন করতে দেশেই প্ল্যান্ট স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু দেশের মধ্যে প্রচুর ই-বর্জ্য থাকলেও কোনো নিয়ম-কানুন বা পদ্ধতি না থাকায় আমরা পর্যাপ্ত বর্জ্য পাচ্ছি না। সবার ঘরেই বাতিল মোবাইল আছে; কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তো এটা আমরা কিংবা যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছেন তাদের কাছে আসতে হবে।’

বিধিমালা আছে বাস্তবায়ন নেই

২০২১ সালের ১০ জুন ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’-এর গেজেট জারি করে সরকার। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিধিমালায় অনেক ভালো বিষয় রয়েছে; কিন্তু এটিও বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ নেই।

বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’-এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- পেতে হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ বছরের কারাদ- বা ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- পেতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধিমালায় প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী, বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী, বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে।

 দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছর ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছর ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে বিধিমালায়।

বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী, ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মেরামতকারী, সংগ্রহকেন্দ্র, ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় ব্যবহারকারীর/প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা, চূর্ণকারী এবং পুনঃব্যবহার উপযোগীকারীর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে—প্রস্তুতকারক ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতের সময় উৎপাদিত যে কোনো ই-বর্জ্য পুনঃব্যবহারোপযোগী বা ধ্বংস করার জন্য সংগ্রহ করবে। সব ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্যে দেশের কোড, ক্রমিক নম্বরসহ কোম্পানি কোড বা ব্যক্তিগত পরিচয় ব্যবহার, মেরামতকারী, চূর্ণকারী ও পুনঃব্যবহার উপযোগীকারী বরাবর ই-বর্জ্য সরবরাহ করবে।

 ফ্লুরোসেন্ট এবং মারকারি যুক্ত বাতির ক্ষেত্রে যেখানে পুনঃচক্রায়নকারী পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে এই ই-বর্জ্য মজুদ এবং নিষ্পত্তির সুবিধার জন্য সংগ্রহকেন্দ্রে সরবরাহ করবে উৎপাদনকারী।

ই-বর্জ্য রাখার জন্য উৎপাদনকারী ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমন্বিতভাবে সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করবে। ই-বর্জ্যরে পরিবেশসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যক্তিগত বা যৌথ উদ্যোগে অর্থায়নের ব্যবস্থাও করবে উৎপাদনকারী।

ই-বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ব্যবসায়ীরা বিক্রেতা এবং নিবন্ধিত সংগ্রহকেন্দ্রের নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর এবং ইমেইল নম্বর ইত্যাদি পণ্যের গায়ে বা মোড়কের গায়ে উল্লেখ বা ভোক্তা ও বড় ব্যবহারকারী ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করবে।

মেয়াদোত্তীর্ণ, অকেজো হওয়ার কারণে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য ফেরত দেওয়ার সময় ভোক্তাকে সরকার নির্ধারিত অর্থ বা প্রণোদনা হিসেবে দেবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়—প্রত্যেক ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার ভোক্তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত স্থানে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে নিরাপদ পরিবহনের মাধ্যমে সংগ্রহকেন্দ্রে পাঠাবেন। প্রত্যেক মেরামতকারী মেরামত প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে তা অনুমোদিত সংগ্রহকেন্দ্রে পাঠাবেন।

বিধিমালা অনুযায়ী যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত বা ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্য বা এর অংশবিশেষ ভাঙার কাজে নিয়োজিত তিনি হচ্ছেন চূর্ণকারী। চূর্ণকারীকে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের নিবন্ধন ও ছাড়পত্র নিতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন

বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মজুদকারী, পরিবহনকারী, মেরামতকারী, সংগ্রহকেন্দ্র, চূর্ণকারী, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী, নিলাম বিক্রেতা ও রপ্তানিকারককে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

দেশে ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে রপ্তানিকারক পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে তা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবেন বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রত্যেক প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহকেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিনের বেশি মজুদ রাখতে পারবেন না। কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদফতর আরও ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়াতে পারবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি

ই-বর্জ্য মজুদের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ই-বর্জ্য যাতে মাটি, পানি বা বায়ুর সঙ্গে সংমিশ্রিত না হয়, সেজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

কোনো পুরনো বা ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস পণ্য আমদানি করা বা দান-অনুদান বা অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করা যাবে না। তবে গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য অধিদপ্তরের অনাপত্তি গ্রহণের মাধ্যমে আমদানি বা গ্রহণ করা যাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //